Tuesday, May 31, 2016

বিষয়ঃ ভ্রমণ


প্রিয় পাঠক/ব্লগার,

শিল্পী ভাস্কর রামকিংকরের বিখ্যাত ভাস্কর্য "ধান ঝাড়াই"
শিল্পী ভাস্কর রামকিংকরের বিখ্যাত ভাস্কর্য “ধান ঝাড়াই”


আধুনিক বাঙালীর তীর্থক্ষেত্র শান্তিনিকেতন
 

ভ্রমণ পিপাসু বাঙালীর কাছে শান্তিনিকেতন হল অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট। কিন্ত শিক্ষিত আধুনিক বাঙালীর কাছে শান্তিনিকেতন হল তীর্থক্ষেত্র। প্রবীণ মানুষদের কাছে যেমন বেনারস বা কাশীর যে গুরুত্ব তেমন গুরুত্ব আছে রবীন্দ্রনাথের মতন মনীষীর অপার কীর্তির উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বেশ কয়েকটি প্রজন্মের বাঙালীর কাছে এ কথা বোধহয় আমরা আজ আর কেউই অস্বীকার করতে পারব না। সুতরাং সেই টানেই বারেবারেই ছুটে যাওয়া ওখানে। অনেকবারই যাওয়া হয়েছে, গত মাসেও একবার গিয়েছি। যখনই গিয়েছি কোনও না কোনো কাজ নিয়ে গিয়েছি। ঘুরেছি ফিরেছি, প্রদর্শনী করেছি, ছবি তুলেছি। কোনও উইক এন্ড কাটানো নয়, যাওয়ার কথা হলে মনটা নেচে উঠেছে নিছক এক মানসিক তৃপ্তির জন্য। সবসময় মনে হতো শান্তিনিকেতন কখনও পুরোনো হয় না আর আজকের দিনে আমাদের আছেটাই বা কি? রবি ঠাকুরকে বাদ দিলে তো বাঙালীর কোনও ভবিষ্যৎ নেই! অন্ততঃ এখনও পর্যন্ত সেইরকম কোনও বাঙালীর জন্ম হয় নি যিনি আমাদের সমস্ত ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিতে পারেন! অসাধারণ এক প্রাজ্ঞতা নিয়ে তিনি যে পরিবেশ পরিমণ্ডলটা গড়ে তুলেছিলেন তার ছোঁয়া পেয়ে তাঁর মৃত্যুর ৬০-৭০ বছর পর জন্ম নেওয়া এখনকার প্রজন্মের এক বছর কুড়ির ছেলের মনও যে নাড়া খেয়ে যায়, সেটা ভাবলে বোঝা যায় যে তাঁর চিন্তাশক্তির ক্ষমতা কি অসীম ছিল যে আজও তা সমানভাবে সক্রিয়! দূর থেকে দেখা নয়, শুধু পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয় রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে আজকের প্রজন্মের কোনও নবাগতকে তাঁর কীর্তির সান্নিধ্যে এনে দেওয়া উচিত এই কথা ভেবেই এই পারিবারিক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে হাজির হওয়া শান্তিনিকেতনে। পাঁচদিনের ভ্রমণে কলাভবন, সঙ্গীতভবন, মিউজিয়াম, নন্দন আর্টগ্যালারী, প্রতীচী ট্রাস্ট, সোনাঝুরি, হাট, খোয়াই, কোপাই, প্রান্তিক স্টেশান ও কংকালীতলা অবধি যাতায়াত সম্ভব হয়েছে, আরও অনেক কিছু বাকী রইল ভবিষ্যতের জন্য। এই পাঁচদিনের ভ্রমণে অনেক ছবি তোলা হয়েছে, তার থেকে কিছু বাছাই করে এখানে দেওয়া হল।

পাঁচদিনের পথ পরিক্রমা

পাঁচ দিনের জন্য গেস্ট হাউসে ঘাঁটি গেড়ে থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতন খাওয়া ঘুম বা অবসর উপভোগ করতে করতে আমরা বেরিয়ে পড়েছি ঘুরতে। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রচুর টোটো, তাতে চড়ে টো টো করে ঘুরেছি, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মেরেছি, আমাদের মতন অনেক ট্যুরিস্টদের সঙ্গে গল্প গুজব হয়েছে, তার মধ্যে এমন লোকেরও সন্ধান পাওয়া গেছে যিনি বাউল গান নিয়ে মেতে থাকেন। বাউলদের বিভিন্ন আখড়ায় সুযোগ পেলেই তিনি হাজির হন বাউল গান শোনার জন্য। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে বেশ মজা পাওয়া যায়—বীরভূম অঞ্চলের কথ্য বাংলার অদ্ভুত টানে কথা শুনতে ভাল লাগে, মাটির গন্ধ যেন তাতে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায় যে অভাব অভিযোগ আছে কিন্তু বিশ্বভারতী সহ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁদের মনে অসীম শ্রদ্ধা আছে। শান্তিনিকেতন যে কলুষিত হচ্ছে না তা নয় –- সে তো কলকাতায় বসে খবরের কাগজেই আমরা পড়ি, তবুও একটা চেষ্টা আছে শান্তিনিকেতনকে তার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবার। রাষ্ট্রের চোখে সে তো নয়নের মণি, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নজর এড়ায় না।

আমরা বীরভূম গেস্ট হাউসে ছিলাম, গেস্ট হাউসটা সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গেস্ট হাউসের মালিক দেবুদা থেকে হাউসের কর্মচারীদের ব্যবহার খুবই সচ্ছন্দ, একটা হোমলি অ্যাটমোস্ফিয়ার আছে। ঠিক যেমন ট্যুরিস্টদের সঙ্গে হোটেল, দোকানদার বা রাস্তাঘাটের মানুষ, টোটো থেকে রিকশা চালকদের ব্যবহার বেশ নম্র-ভদ্র। ব্যতিক্রম নেই সেকথা বলব না তবে সেটা বাড়াবাড়ি রকমের নয়।

ভোরের শান্তিনিকেতন অসাধারণ, মনোমুগ্ধকর! বড়বড় বৃক্ষরাজিতে ভরা শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে দারুণ মজা লাগে। গেস্ট হাউসের উল্টোদিকের একটা চায়ের দোকানে বসে চা জলখাবার খেতে খেতে আমরা সকালের শান্তিনিকেতন উপভোগ করতাম! আর খালপাড়ের বউদির হোটেলে শস্তার সুস্বাদু মিল ছিল আমাদের রোজকার দুপুরের আহার। এই পূর্বাশা হোটেলের খুব নাম, দূর দূরান্ত থেকে লোকে খেতে আসে। এই খালপাড়ের কাছেই সোনাঝুরি আর সেই বিখ্যাত খোয়াই—যার পাড়ে অদ্ভুত সব ফর্ম অথবা ন্যাচারাল আর্কিটেকচার দেখে ছবি তোলায় নেশা ধরে যায়। এই খোয়াই-এর পাড়ে একটা হাট বসে প্রতি শনিবার, দুপুর ২টো থেকে সন্ধ্যা ৬টা অবধি এই হাটে জমজমাট ভীড় হয়, কেনাবেচা চলে নানারকম ক্রাফট, জামাকাপড় থেকে কাঠের জিনিস, মণিহারী জিনিস, বাউলদের মনমাতানো গান মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। শহর থেকে আসা বয়স্ক মানুষ ও এখনকার প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের দেখেছি অবাক হয়ে বাউলের গান শুনতে, চোখে মুখে ফুটে ওঠা আনন্দ দেখে মনেহয় যেন শিকড়ের খোঁজে এখানে আসা। স্রোতারা গান শুনছেন, রেকর্ড করছেন, ভিডিও তুলছেন আবার প্রচুর ডোনেশান দিচ্ছেন বাউলদের—এটাই দেখবার মত বিষয় যে আমাদের ট্রাডিশানের ব্যাপারে সাধারণ শহুরে মানুষদের মধ্যে একটা বিরাট সচেতনতা তৈরী হয়েছে।

সোনাঝুরির কাছেই আছে প্রয়াত শিক্ষক ও শিল্পী বাঁধন দাসের বাড়ী (যেখানে বাঁধনদাও একটা হাট চালু করেছিলেন), স্বাদ এবং বসুন্ধরা আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট সেন্টার। স্বাদ (এস এস ভি এ ডি বা শান্তিনিকেতন সোসাইটি অফ ভিস্যুয়াল আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন) – যে প্রতিষ্ঠানকে বিশিষ্ট শিল্পী যোগেন চৌধুরীর নেতৃত্বে শান্তিনিকেতনে বসবাসকারী শিল্পী এবং কলাভবনের অধ্যাপকরা গড়ে তুলেছেন একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হিসাবে। দেশ বিদেশ থেকে আসা নানান শিল্পী এখানে ওয়ার্কশপ, প্রদর্শনী করে থাকেন। এই প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে গুণীজনদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার দেওয়া হয়। ভবিষ্যতের শিল্পীদের পক্ষে এই শিল্প-কেন্দ্র যে একটা বড়সড় ভূমিকা নেবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

একদিন পরিচ্ছন্ন প্রান্তিক স্টেশান পেরিয়ে আমরা কঙ্কালীতলায় গেলাম। কঙ্কালীতলা বাহান্ন পীঠেরএক পীঠ। মন্দির দর্শন সেরে আশপাশ ঘুরে কোপাই নদী দেখলাম। সংকীর্ণ কোপাই-এর পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানো রয়েছে দেখলাম। এখান থেকে ফেরার পথে বিশ্ববাংলা-র সেন্টার দেখলাম। সুন্দরভাবে গড়ে তোলা হয়েছে সেন্টার-টা। তবে আমরা যখন গিয়েছি তখন দোকানপাট খোলে নি তখনো। ফলে কেনাকাটা কিছু হয় নি, বরং সোনাঝুরির হাট থেকে অনেক কিছু কেনা হয়েছে। পরিবারের তরফ থেকে এই কেনাকাটায় মূল উদ্যোগ ছিল আমার স্ত্রী ছন্দার, সঙ্গে ছিল আমার পুত্র নির্মাল্য, ওদের দু’জনের এই ভ্রমণপর্ব ভীষণ ভালো লেগেছে জেনে আমার একটা সোয়াস্তি ছিল। কলাভবন চত্বরে সংরক্ষিত প্রবাদপ্রতিম শিল্পী-ভাস্কর রামকিংকরের গড়া ভাস্কর্যগুলো ঘুরেফিরে দেখতে হয়েছে, দেখতে হয়েছে আর এক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের গড়া বিশাল মিউরাল (কলাভবন ক্যান্টিন-এর দেয়াল), ছাত্রাবাসের কাজগুলো, সোমনাথ হোড় ও মানিদা’র করা মিউরাল এবং আরও অনেকের করা লোহা বা স্টীলে তৈরী স্কাল্পচার – এসব যত দেখেছি ততই মন আবেগঘন হয়ে উঠেছে। এর আগেও অনেকবার দেখেছি কিন্তু ফিরে ফিরে দেখার মধ্যে যে অন্য ভালো লাগা আছে সেকথা অনুভূতিতে ধরা দিল। আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার ছেলেকে এইসব অসাধারণ সৃষ্টিগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার, ওর ভালোলাগা দেখে বুঝলাম আমার কাজ সার্থক হয়েছে। আরও অনেককিছু দেখার ইচ্ছা ছিল আমাদের কিন্তু পাঁচদিনের পর্ব শেষে একটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মন নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হল। বাসনা রইল অদূর ভবিষ্যতে আবার শান্তিনিকেতনে যাবার।

* একটা কথা জানিয়ে রাখি যে, যদিও এটা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক তবুও না বলে পারছি না যে শান্তিনিকেতনের কোথাও কোনও কাক আমরা দেখতে পাইনি। এই অদ্ভুত ঘটনাটা আমরা লক্ষ্য করেছি। জানিনা এর কি কারণ, তবে জানতে হবে।

বিগত দিনের পরিক্রমা

গতমাসে অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমি আর আমার বন্ধু নবকুমার দু’দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে হাজির হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল স্বাদ এবং নন্দন আর্ট গ্যালারী ভিজিট করা আর কিছু দরকারী কাজকর্ম সারা। এর সঙ্গে ছিল নন্দন আর্ট গ্যালারীতে আমাদের এক বন্ধুর স্ত্রীর চিত্র প্রদর্শনী দেখা। সেইমত গণদেবতা এক্সপ্রেস ধরে সকাল সকাল শান্তিনিকেতনে হাজির হয়ে দরকারী কাজগুলো মিটিয়ে নিলাম। প্রথমে স্বাদ-এ উপস্থিত হয়ে স্বাদ-এর পরিচালক শ্রীমতি জয়লক্ষ্মী সিংহ রায়-এর সঙ্গে দেখা করলাম, তিনি খুব আতিথেয়তা করলেন, অনেক কথাবার্তা হল তারপর স্বাদ আয়োজিত একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী দেখলাম, খুব ভালো ভালো কাজ চোখে পড়ল। নীচের বেসমেন্টের ওয়ার্কশপে কয়েকজন উঠিত শিল্পী কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল অনেক কথাবার্তা হল। ২০১৩-তে এখানে আমরা প্রদর্শনী করেছিলাম। দেখলাম স্বাদ-এর পাশে একটা গোটা বাড়ীকে অত্যাধুনিক চেহারার গ্রাফিক্স স্টুডিওতে পরিণত করেছেন স্বাদ-এর পরিচালক বর্গ। এরপর হোটেল পূর্বাশায় দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি সোনাঝুরি হাট এবং নন্দন আর্ট গ্যালারীর উদ্দেশ্যে। সোনাঝুরি হাট দেখতে গিয়ে খোয়াই-এর পাড় দেখার জন্য খাদের মধ্যে নেমে পড়ি আমি আর নব। ঘুরতে ঘুরতে দেখতে থাকি, লোভ সামলাতে পারিনি, মোবাইল ক্যামেরাতে একের পর এক ছবি তুলতে থাকি। সে কি অসাধারণ বিচিত্র নৈসর্গিক স্থাপত্য, যেমন তার ভাঙন, তেমনি তার মোচড়, কার্ভেচার, মাটির অদ্ভুত সব ফর্ম। তার মধ্যে মধ্যে রোদ্দুরের খেলা, গাছপালা, পাখির কলরব। নব তো প্রকৃতি-পাগল, সঙ্গের ক্যামেরা ফোকাস করে একের পর এক ছবি তুলে গেছে। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটা বিশেষ প্রয়োজনে গ্রাউন্ড লেভেল থেকে ছবি নেওয়া, সেটা করতে করতে খোয়াই-এর দেয়ালেরও ছবি আর ভিডিও তুলতে থাকি। এইসব করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, আমরা তাড়াতাড়ি হাটে এসে কিছু খুঁটিনাটি জিনিস বিশেষ করে গ্রামীণ ক্রাফট আইটেমগুলো দেখে নিয়ে, খানিকটা সময় বাউলদের গান শুনে নিয়ে কলাভবনের দিকে হাঁটা দিই। ওখানে নন্দন আর্ট গ্যালারীতে শুক্তি রায়ের শিল্পকলা প্রদর্শনী চলছিল। শুক্তির হাসব্যান্ড চয়নও ওখানে ছিল। দেখা হল দুজনের সঙ্গেই। আমরা প্রদর্শনী দেখলাম। অনেক আড্ডা হল। নব আর আমি প্রচুর ছবি তুললাম, ভিডিও তুললাম। এরপর আমার ইচ্ছা ছিল সারাদিনের ক্লান্তিকর হাঁটাহাঁটির পর একটু রসেবসে থাকা, কিন্তু বেশী টাকাপয়সা সঙ্গে না থাকায় ঐ আশা পরিত্যক্ত হয়। শুক্তি আর চয়ন গেস্ট হাউসে ফিরে গেল আমরাও আমাদের বীরভূম গেস্ট হাউসে ফিরে আসি, উল্টো দিকের চায়ের দোকানে বসে চা তেলেভাজা খেয়ে গল্পগুজব করতে করতে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিয়ে রাত ন’টার সময় বৌদির হোটেলে রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্রান্তিক স্টেশানের দিকে কিছুদূর গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে ভালই লাগছিল। চারদিকে নিশুতি রাত আর মাথার উপর গোলাকার চাঁদ, অপূর্ব সে দৃশ্য! মনে রাখার মতন।

পরদিন ছিল রোববার। সাত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে চা জলখাবার খেয়ে নিয়ে আমরা সোজা চলে যাই খালপাড়ের কাছে নেচার ইন্টারপ্রিটেশান সেন্টার-এর কাছে, ওখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে করতে আমরা পৌঁছে যাই লালবাঁধে। ২০১৩-তে প্রথমবার এখানে ঘুরে এসেছিলাম। ভীষণ ভালো লেগেছিল। বিশাল একটা জলাশয়, তাতে একদিকে ধোপারা কাপড় কাচছেন আর একদিকে পাখ পাখালি টল টলে   জল, ঝলমলে রোদ্দুর! আশপাশে কাঁকর নুড়ি মেশানো লাল মাটির জমি, পায়ে হাঁটা পথ। মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা ঘাসের গোছা, দেখলেই বোঝা যায় এই রাঢ় বাংলার দৃশ্য নন্দলান, রামকিঙ্কর বা বিনোদবিহারীর কাজে কতটা প্রভাব ফেলেছিল। ওঁরা যে এখানে আসতেন, আউটডোর করতেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। লালবাঁধের এই দৃশ্য দেখলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নন্দলাল বা রামকিঙ্ককরের ছবি। নব’র ক্যামেরার শাটার তো ওঠানামা করে যাচ্ছেই আমিও আমার মোবাইল ক্যামেরায় ছবি আর ভিডিও তুলে রাখছি। গ্রাউন্ড লেভেলে জমির ছবি, নানা রকম টেক্সচারের ছবি আমার দরকার বলে প্রচুর ভিডিও করলাম, স্টীল ইমেজও নিতে থাকলাম। লালবাঁধ হচ্ছে শ্যামবাটীর পিছনে। শ্যামবাটীর রাস্তা থেকে জলাশয় অবধি একটা বিরাট লালমাটি নুড়ি কাঁকরের প্রান্তর, এখানে শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের করা অনেকগুলো আকর্ষণীয় ওপেন এয়ার আর্ট অবজেক্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, এর নাম দেওয়া হয়েছে “লালবাঁধ ইকো-জোন, এনভায়রনমেন্টাল স্কাল্পচার পার্ক ”, ২০১৪-র ৯ আগস্ট এর উদ্বোধন করেছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য শ্রী সুশান্ত দত্তগুপ্ত। এই জায়গাতে আমাদের ছবি ভিডিও তোলাটা   এমন এক পাগলামীতে পৌঁছেছিলো যে একজন সিকিউরিটি গার্ড তো উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগলো এরা করে কি?! আসলে শরীরের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে মাটির দিকে তাক করে আমি ভিডিও রেকর্ডিং করছিলাম, একজায়গায় বোঁ বোঁ করে এমন ঘুরপাক খেতে লাগলাম যে ঐ সিকিউরিটি গার্ডের হয়তো মনে হয়েছে যে আমার শরীর টরীর নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে! প্রকৃতিও যে কাউকে পাগল বানাতে পারে এটা আমি সেদিন অনুভব করলাম! আমার প্রয়োজনীয় শটস নিয়ে আমি খুব খুশী হয়েছি আর নবকুমার যে কত পাখীর ছবি তুলল তার ইয়ত্তা নেই! এইসব করতে করতে আমরা দুপুরের মধ্যে গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম।

গেস্ট হাউসে ফিরে স্নান সেরে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে গেস্ট হাউস ছেড়ে একেবারে আমরা বেরিয়ে এলাম এবং শুক্তির প্রদর্শনীতে গিয়ে হাজির হলাম, কেননা আগের দিন বেশীক্ষণ থাকা হয় নি, আজকে অনেকক্ষণ থাকার ইচ্ছা। এছাড়া সন্ধ্যা ৬ টার গণপতি এক্সপ্রেসে ফেরার টিকিট রিজার্ভেশান, হাতে ঘন্টা কয়েক সময় পাওয়া যাবে আড্ডা মারার জন্য। প্রদর্শনী হলে ব্যাগ রেখে নব, আমি আর চয়ন কলাভবনের কাছাকাছি মাটির হোটেলে মাছভাত খেয়ে এলাম, চয়নই বিল পেমেন্ট করলো। এদিক ওদিক একটু ঘোরাঘুরি করে শুক্তির জন্য কিছু কিনে নিয়ে হলে এসে দেখি লালা বসে আছে। লালা আমাদের পুরনো বন্ধু। সেই কবে আর্ট কলেজে অ্যাডমিশানের সময় লালার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। তারপর কলেজ পর্ব মিটলে ৮০-র দশকে যে একদল সদ্য পাশ করা আর্টিস্ট শান্তিনিকেতনে এসে ঘাঁটি গাড়ে লালা তাদের মধ্যে একজন। লালারা এখানে থাকতে শুরু করে, ছবি আঁকাও চলতে থাকে, পরে ওরা সোনাঝুরির আশপাশে সাঁওতাল গ্রামের কাছাকাছি জমি কিনে মাটির বাড়ী বানিয়ে থাকতে শুরু করে। সেই বাড়ী আজও আছে। লালার পাকাপোক্ত মাটির বাড়ী এই ২০১৩-তে গিয়ে আমি প্রথম দেখি। শান্তিনিকেতনকে সেন্টার করে লালা বম্বে-কলকাতা- দিল্লীতে যাওয়া আসা করে পেশাদারীত্বের কারণে। মূলতঃ ছবি বিক্রী ও কমিশান ওয়ার্ক করেই লালার সংসার চলে। লালা বিবাহিত, ওর স্ত্রীর নাম মঞ্জুরী। তবে এই দম্পতি কখনো দিল্লী কখনো শান্তিনিকেতনে থাকে। সেই লালার সঙ্গে ২০১৩-র পর আবার দেখা। পুরনো অনেক কথাবার্তা হল। আমাদের আর এক বন্ধু যীশুর কথা উঠল। সে আর বেঁচে নেই। কয়েকমাস হল যীশু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। লালা ওর সম্পর্কে কিছু বলল। দিল্লীতে থাকাকালীন ওদের যোগাযোগ ছিল। যাইহোক, নন্দন আর্ট গ্যালারীতে শুক্তির প্রদর্শনীর খবর পেয়ে লালা হাজির হয়েছে; আসলে শুক্তি ও চয়ন লালাদেরও পুরনো বন্ধু। আগেরদিন শুক্তির একজিবিশানের উপর অনেক ছবি তুলেছিলাম, আজও কিছু তুললাম। ওরা জানালো প্রদর্শনী উদ্বোধনের দিন ভালো ভীড় হয়েছে, বিশ্বভারতী থেকে অনেকেই এসেছেন, এছাড়া রোজই ফ্লাইং দর্শকদের ভালো ভীড় হয়েছে। পরদিন শুক্তির প্রদর্শনী শেষ হবে। আমরা তো থাকব না। আজই ফিরতে হবে। বিকেল হয়ে আসছে, তাই রেডি হতে শুরু করলাম। নীচের কক্ষে কলাভবন আয়োজিত শিল্পী-ভাস্কর বিকাশ দেবনাথ-এর প্রদর্শনী চলছিল, আমরা একবার দেখে নিলাম। বিদায় নেবার সময় লালা সবাইকে একবার জড়িয়ে ধরল। আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। একটা টোটো নিয়ে বোলপুর স্টেশানের দিকে রওনা দিলাম। মনটা স্বভাবতই ভারাক্রান্ত! শরীর ক্লান্ত ছিল, খানিকটা ঝিমোতে ঝিমোতে গণপতি এক্সপ্রেস ধরে হাওড়ায় নামলাম। তারপর যে যার বাড়ী। এর ঠিক একমাস বাদেই আবার হাজির হলাম শান্তিনিকেতনে একটা পারিবারিক ভ্রমণের উদ্দেশ্য যার কথা এই লেখার গোড়াতেই দেওয়া আছে। আর দেওয়া রইলো প্রচুর ছবি, পাঠকের ভাল লাগলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। আপনাদের জন্য শুভেচ্ছা রইলো। ধন্যবাদ!
ফটোগ্রাফি-  উল্লিখিত ছবিগুলো ছাড়া বাকী সমস্ত ছবি লেখকের তোলা।

বি.দ্রঃ - প্রচুর ছবি আপ্লোড করা আছে। আপনারা দেখতে চাইলে নিচের লিংকে ক্লিক করুন। বাংলাব্লগের ওয়ার্ডপ্রেশ স্লাইডারের মাধ্যমে ছবি দেখতে পাবেন। 

বিষয়ঃ ভ্রমণ

–- নীলোৎপল সিংহ
Posted in ভ্রমণ, সাহিত্য | Tagged , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , , | মন্তব্য দিন | সম্পাদনা

No comments :

Post a Comment