ভ্রমণ পিপাসু বাঙালীর কাছে শান্তিনিকেতন হল অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট। কিন্ত শিক্ষিত আধুনিক বাঙালীর কাছে শান্তিনিকেতন হল তীর্থক্ষেত্র। প্রবীণ মানুষদের কাছে যেমন বেনারস বা কাশীর যে গুরুত্ব তেমন গুরুত্ব আছে রবীন্দ্রনাথের মতন মনীষীর অপার কীর্তির উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বেশ কয়েকটি প্রজন্মের বাঙালীর কাছে এ কথা বোধহয় আমরা আজ আর কেউই অস্বীকার করতে পারব না। সুতরাং সেই টানেই বারেবারেই ছুটে যাওয়া ওখানে। অনেকবারই যাওয়া হয়েছে, গত মাসেও একবার গিয়েছি। যখনই গিয়েছি কোনও না কোনো কাজ নিয়ে গিয়েছি। ঘুরেছি ফিরেছি, প্রদর্শনী করেছি, ছবি তুলেছি। কোনও উইক এন্ড কাটানো নয়, যাওয়ার কথা হলে মনটা নেচে উঠেছে নিছক এক মানসিক তৃপ্তির জন্য। সবসময় মনে হতো শান্তিনিকেতন কখনও পুরোনো হয় না আর আজকের দিনে আমাদের আছেটাই বা কি? রবি ঠাকুরকে বাদ দিলে তো বাঙালীর কোনও ভবিষ্যৎ নেই! অন্ততঃ এখনও পর্যন্ত সেইরকম কোনও বাঙালীর জন্ম হয় নি যিনি আমাদের সমস্ত ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিতে পারেন! অসাধারণ এক প্রাজ্ঞতা নিয়ে তিনি যে পরিবেশ পরিমণ্ডলটা গড়ে তুলেছিলেন তার ছোঁয়া পেয়ে তাঁর মৃত্যুর ৬০-৭০ বছর পর জন্ম নেওয়া এখনকার প্রজন্মের এক বছর কুড়ির ছেলের মনও যে নাড়া খেয়ে যায়, সেটা ভাবলে বোঝা যায় যে তাঁর চিন্তাশক্তির ক্ষমতা কি অসীম ছিল যে আজও তা সমানভাবে সক্রিয়! দূর থেকে দেখা নয়, শুধু পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয় রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে আজকের প্রজন্মের কোনও নবাগতকে তাঁর কীর্তির সান্নিধ্যে এনে দেওয়া উচিত এই কথা ভেবেই এই পারিবারিক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে হাজির হওয়া শান্তিনিকেতনে। পাঁচদিনের ভ্রমণে কলাভবন, সঙ্গীতভবন, মিউজিয়াম, নন্দন আর্টগ্যালারী, প্রতীচী ট্রাস্ট, সোনাঝুরি, হাট, খোয়াই, কোপাই, প্রান্তিক স্টেশান ও কংকালীতলা অবধি যাতায়াত সম্ভব হয়েছে, আরও অনেক কিছু বাকী রইল ভবিষ্যতের জন্য। এই পাঁচদিনের ভ্রমণে অনেক ছবি তোলা হয়েছে, তার থেকে কিছু বাছাই করে এখানে দেওয়া হল।
পাঁচদিনের পথ পরিক্রমা
পাঁচ দিনের জন্য গেস্ট হাউসে ঘাঁটি গেড়ে থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতন খাওয়া ঘুম বা অবসর উপভোগ করতে করতে আমরা বেরিয়ে পড়েছি ঘুরতে। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রচুর টোটো, তাতে চড়ে টো টো করে ঘুরেছি, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মেরেছি, আমাদের মতন অনেক ট্যুরিস্টদের সঙ্গে গল্প গুজব হয়েছে, তার মধ্যে এমন লোকেরও সন্ধান পাওয়া গেছে যিনি বাউল গান নিয়ে মেতে থাকেন। বাউলদের বিভিন্ন আখড়ায় সুযোগ পেলেই তিনি হাজির হন বাউল গান শোনার জন্য। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে বেশ মজা পাওয়া যায়—বীরভূম অঞ্চলের কথ্য বাংলার অদ্ভুত টানে কথা শুনতে ভাল লাগে, মাটির গন্ধ যেন তাতে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায় যে অভাব অভিযোগ আছে কিন্তু বিশ্বভারতী সহ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁদের মনে অসীম শ্রদ্ধা আছে। শান্তিনিকেতন যে কলুষিত হচ্ছে না তা নয় –- সে তো কলকাতায় বসে খবরের কাগজেই আমরা পড়ি, তবুও একটা চেষ্টা আছে শান্তিনিকেতনকে তার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবার। রাষ্ট্রের চোখে সে তো নয়নের মণি, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নজর এড়ায় না।
আমরা বীরভূম গেস্ট হাউসে ছিলাম, গেস্ট হাউসটা সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গেস্ট হাউসের মালিক দেবুদা থেকে হাউসের কর্মচারীদের ব্যবহার খুবই সচ্ছন্দ, একটা হোমলি অ্যাটমোস্ফিয়ার আছে। ঠিক যেমন ট্যুরিস্টদের সঙ্গে হোটেল, দোকানদার বা রাস্তাঘাটের মানুষ, টোটো থেকে রিকশা চালকদের ব্যবহার বেশ নম্র-ভদ্র। ব্যতিক্রম নেই সেকথা বলব না তবে সেটা বাড়াবাড়ি রকমের নয়।
ভোরের শান্তিনিকেতন অসাধারণ, মনোমুগ্ধকর! বড়বড় বৃক্ষরাজিতে ভরা শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে দারুণ মজা লাগে। গেস্ট হাউসের উল্টোদিকের একটা চায়ের দোকানে বসে চা জলখাবার খেতে খেতে আমরা সকালের শান্তিনিকেতন উপভোগ করতাম! আর খালপাড়ের বউদির হোটেলে শস্তার সুস্বাদু মিল ছিল আমাদের রোজকার দুপুরের আহার। এই পূর্বাশা হোটেলের খুব নাম, দূর দূরান্ত থেকে লোকে খেতে আসে। এই খালপাড়ের কাছেই সোনাঝুরি আর সেই বিখ্যাত খোয়াই—যার পাড়ে অদ্ভুত সব ফর্ম অথবা ন্যাচারাল আর্কিটেকচার দেখে ছবি তোলায় নেশা ধরে যায়। এই খোয়াই-এর পাড়ে একটা হাট বসে প্রতি শনিবার, দুপুর ২টো থেকে সন্ধ্যা ৬টা অবধি এই হাটে জমজমাট ভীড় হয়, কেনাবেচা চলে নানারকম ক্রাফট, জামাকাপড় থেকে কাঠের জিনিস, মণিহারী জিনিস, বাউলদের মনমাতানো গান মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। শহর থেকে আসা বয়স্ক মানুষ ও এখনকার প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের দেখেছি অবাক হয়ে বাউলের গান শুনতে, চোখে মুখে ফুটে ওঠা আনন্দ দেখে মনেহয় যেন শিকড়ের খোঁজে এখানে আসা। স্রোতারা গান শুনছেন, রেকর্ড করছেন, ভিডিও তুলছেন আবার প্রচুর ডোনেশান দিচ্ছেন বাউলদের—এটাই দেখবার মত বিষয় যে আমাদের ট্রাডিশানের ব্যাপারে সাধারণ শহুরে মানুষদের মধ্যে একটা বিরাট সচেতনতা তৈরী হয়েছে।
সোনাঝুরির কাছেই আছে প্রয়াত শিক্ষক ও শিল্পী বাঁধন দাসের বাড়ী (যেখানে বাঁধনদাও একটা হাট চালু করেছিলেন), স্বাদ এবং বসুন্ধরা আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট সেন্টার। স্বাদ (এস এস ভি এ ডি বা শান্তিনিকেতন সোসাইটি অফ ভিস্যুয়াল আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন) – যে প্রতিষ্ঠানকে বিশিষ্ট শিল্পী যোগেন চৌধুরীর নেতৃত্বে শান্তিনিকেতনে বসবাসকারী শিল্পী এবং কলাভবনের অধ্যাপকরা গড়ে তুলেছেন একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হিসাবে। দেশ বিদেশ থেকে আসা নানান শিল্পী এখানে ওয়ার্কশপ, প্রদর্শনী করে থাকেন। এই প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে গুণীজনদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার দেওয়া হয়। ভবিষ্যতের শিল্পীদের পক্ষে এই শিল্প-কেন্দ্র যে একটা বড়সড় ভূমিকা নেবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
একদিন পরিচ্ছন্ন প্রান্তিক স্টেশান পেরিয়ে আমরা কঙ্কালীতলায় গেলাম। কঙ্কালীতলা বাহান্ন পীঠেরএক পীঠ। মন্দির দর্শন সেরে আশপাশ ঘুরে কোপাই নদী দেখলাম। সংকীর্ণ কোপাই-এর পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানো রয়েছে দেখলাম। এখান থেকে ফেরার পথে বিশ্ববাংলা-র সেন্টার দেখলাম। সুন্দরভাবে গড়ে তোলা হয়েছে সেন্টার-টা। তবে আমরা যখন গিয়েছি তখন দোকানপাট খোলে নি তখনো। ফলে কেনাকাটা কিছু হয় নি, বরং সোনাঝুরির হাট থেকে অনেক কিছু কেনা হয়েছে। পরিবারের তরফ থেকে এই কেনাকাটায় মূল উদ্যোগ ছিল আমার স্ত্রী ছন্দার, সঙ্গে ছিল আমার পুত্র নির্মাল্য, ওদের দু’জনের এই ভ্রমণপর্ব ভীষণ ভালো লেগেছে জেনে আমার একটা সোয়াস্তি ছিল। কলাভবন চত্বরে সংরক্ষিত প্রবাদপ্রতিম শিল্পী-ভাস্কর রামকিংকরের গড়া ভাস্কর্যগুলো ঘুরেফিরে দেখতে হয়েছে, দেখতে হয়েছে আর এক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের গড়া বিশাল মিউরাল (কলাভবন ক্যান্টিন-এর দেয়াল), ছাত্রাবাসের কাজগুলো, সোমনাথ হোড় ও মানিদা’র করা মিউরাল এবং আরও অনেকের করা লোহা বা স্টীলে তৈরী স্কাল্পচার – এসব যত দেখেছি ততই মন আবেগঘন হয়ে উঠেছে। এর আগেও অনেকবার দেখেছি কিন্তু ফিরে ফিরে দেখার মধ্যে যে অন্য ভালো লাগা আছে সেকথা অনুভূতিতে ধরা দিল। আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার ছেলেকে এইসব অসাধারণ সৃষ্টিগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার, ওর ভালোলাগা দেখে বুঝলাম আমার কাজ সার্থক হয়েছে। আরও অনেককিছু দেখার ইচ্ছা ছিল আমাদের কিন্তু পাঁচদিনের পর্ব শেষে একটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মন নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হল। বাসনা রইল অদূর ভবিষ্যতে আবার শান্তিনিকেতনে যাবার।
* একটা কথা জানিয়ে রাখি যে, যদিও এটা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক তবুও না বলে পারছি না যে শান্তিনিকেতনের কোথাও কোনও কাক আমরা দেখতে পাইনি। এই অদ্ভুত ঘটনাটা আমরা লক্ষ্য করেছি। জানিনা এর কি কারণ, তবে জানতে হবে।
No comments :
Post a Comment